অন্যান্যমতামত

তবে কি বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীনদের হাতে?

গেল ২৮ ফেব্রুয়ারি- ২০২৪ মহান জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে নিত্যপণ্যের দাম যদি কেউ বেশি নেয় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার ঠিক একিদিনে পবিত্র রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত,সরবরাহ এবং বাজার মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) নানান পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।

পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির লাগাম টানা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আবার এফবিসিআই সভাপতি বলছেন, অতি মুনাফা ও মজুতদারি মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীদের বেরিয়ে আসতে  আসতে হলে আগে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।

দু দিক থেকেই খুবি ইতিবাচক কথা। কিন্তু মজার বিষয় ও বাস্তবতা হলো, রমজান মাস শুরুই হয়নি অথচ এর আগেই আরেক দফা বেড়েছে বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম আর মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।

সত্যি বলতে কি, প্রায় ৩ বছর ধরে লাগামহীনভাবে বাড়েই জলেছে দ্রব্যমূল্য। প্রতিদিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ একেবারে দিশেহারা হয়ে এখন যেন চোখে অন্ধকার দেখছে। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারনে সাধারণ মানুষ এখন হতাশা রোগে ভুগছে। সরকারের কোনো কথাতেই সাধারণ মানুষ আর ভসো করতে হতে পারছে না।

সামান্য কিছুটা সচ্ছল সম্পন্ন মানুষ ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা এখন যেন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম নিত্যপণ্য কেনাকাটার বাজার ।গেল ৭ জানুয়ারি-২০২৪ এর নির্বাচনের আগে আ: লীগ শাসক দল  নির্বাচনী যে ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, সেখানে দ্রব্যমূলল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণকে একটি  প্রতিশ্রুতির মূল জায়গায় রেখেছিল।

নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেও এ কাজকে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছে বলেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল সরকার। নিয়মিত ব্রিফিং-এ আ: লীগ সাধারণ সম্পাদকও বেশ কয়েক দফায় বলেছেন যে,বিএনপি নয়,তাদের ভাবনা দ্রব্যমূল্যকে নিয়ে।

এ প্রেক্ষিতে আমরা অবশ্য  ভোক্তা অধিকারকে বাজারে কিছিুটা সক্রিয় হতে দেখেছি, স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রীকেই চালের মোকামে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কমছে না দাম ,জনদূর্ভোগ কেবলই বাড়ছে। মহামাড়ি কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই, নয়তো কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিধি কমেছে।এর ফলে আয়-রোজগার ঠেকেগেছে একদম তলানিতে।

সেখান থেকে উত্তরণ ঘটার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন আরেক দফা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। তবে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার পুরো কারণটাই যদি কোভিড-১৯ আর ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে বিষয়টি হয়তোবা নির্বোধের কাজ হবে।

কারণ দেশবাসী দেখেছি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য  আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে সরকার যখন দায়ী করছে,ঠিক তখন আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্ববাজারে নিত্য পণ্যের দাম কমলেও এর কোন প্রভাব পড়ছে না বাংলাদেশের বাজারে।মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অনেক কারণ আছে।

এফবিসিসিআই,এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য ৪টি কারণ চিহ্নিত করেন। তা হলো ডলার সংকট ও এর বাড়তি দাম, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং উচ্চ শুল্ক। কিন্তু বড় একটি কারণের কথা কেউ বলছেন না।না সরকার না ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়া,যার বাস্তব প্রভাব পড়ছে বাজারে। মজার বিষয় বিশ্ববাজারে দাম কমলেও সরকার কমায়না, আবার কমালেও আনুপাতিকহাড়ে কম। অপরদিকে সরকার নিয়মিতভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে ।ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর করছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে।যার ফলে সরাসরি প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যে।

এক টানা এত সময় ধরে একটা সরকার ক্ষমতায়, অথচ তারা মানুষের এই মৌলিক চাহিদার জায়গায় সফল হতে পারছে না। একদিকে বড় বড় উন্নয়নের কথা বলেই চলেছে। অন্যদিকে সিন্ডিকেট, কারসাজি কিংবা মজুদদারি এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছে সরকার। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নানা হাস্যকর কথা বলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।আবার দূর্ণীতি নিয়ে আগের কয়েকজন মন্ত্রীর কেউ বলেন,দূর্ণীতি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চলছে,কেউ বলেন,ব্যবসায়ীদের সব সময় চাপে রাখা যায়না।   আবার কেউ বলেন,পৃথিবীর কেউ বাজার নিয়ন্ত্রন করতে পারবেনা।

একবার বললেন যে, বাজার সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে সরকার কিছু করতে পারছে না। বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু প্রথম কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ করে এখন বলছেন, মানুষের হাতে অনেক টাকা. বাজারে কোনোকিছু অবিক্রীত থাকছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হলেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলে থাকেন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে।এধরনের কথা কখন বলা যায় ক্ষমতায় থেকে সেটিও ভূলে গেছেন তারা।

একদিকে সরকার  বলে, কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আবার অন্যদিকে বলে বাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাত নিয়ন্ত্রণ করা বড় কঠিন।যদি তাই হয়,তবে জ্বালানি খাতে বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা কেন হচ্ছে না?

জ্বালানি তেলের মতো একটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য সরকার এককভাবে সরকারি কোম্পানি বিপিসি আমদানি করে বিপণন করেন এবং তাও বিশ্ববাজারের সাথে তাল মিলিয়ে বিক্রি করে না। বাড়লে এক লাফে বাড়িয়ে ফেলেন, কিন্তু কমলে কমায় না। এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, ভোক্তা অধিদপ্তর কোথায়? ভোক্তা অধিদপ্তরের কাজ কি?

খুচরা ও বড় বাজারে ঢুকে ছোট ছোট কিছু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নানান কিছু করতে পারের ভোক্তা অধিদপ্তর। তবে বিপিসি’র বেলায় ভোক্তা অধিদপ্তরের আইন প্রয়োগ কেন হবে না ? বিপিসিও তো একটি কোম্পানি, এরা তো ব্যবসা করে।তার মানে হলো আসল জায়গায় কবি নাকি নিরব।

আর একটি বিষয় হলো মাত্র কয়েকটি কোম্পানির হাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার জিম্মি।তেল,চিনি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বড় ৩/৪টি কোম্পানি আবার ডিমের বাজারও বড় দুটি কোম্পানির হাতে। এরাই আবার দাম ঠিক করার ক্ষেত্রেও তাদেরই প্রভাব। এর ফলে বাজারে সরকারের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। প্রশ্ন থেকে যায়,ব্যপারটা আসলেই কি তাই? তবে ব্যপারটা যাই হোক না কেন জাতীর কল্যাণ্য এই একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

তবে এই মুহূর্তে ডলার সংকট নিরসন ও শুল্ক কমিয়ে দাম কমাতে না পারলেও সরকার চাঁদাবাজি তো বন্ধ করতে পারে। মানুষের ভাবনাটা মাথায় রেখে অনুধাবন করতে হবে যে, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে মানুষের  সংসার পরিচলনার সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

দিনমজুর,শ্রমিক ও ছোট ছোট কর্মীরা আগের চেয়ে অনেক কম দিন কাজ পাচ্ছেন। অনেক কর্মক্ষেত্রে ওভারটাইমও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ব্যক্তিখাতে ঠিকমতো বেতনও হচ্ছে না। যার কারনে মানুষের আয় কমে গেছে অনেকাংশে  । মানুষের পকেটে অনেক টাকা আছে এই সব জাতীয় বুলি ছেড়ে দিয়ে মানুষের কষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে ।

শুধু আমি নই, এখন একটি মাত্র ভাবনা বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অসহায় ও একেবারে হতদরিদ্র মনুষকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে তাহলো ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে যা প্রয়োজন তাই করছে। যেমন খুশি তেমন করে ভোট করছে।আবার ভোটের ক্ষেত্রে একই দলের প্রার্থী হয়ে কেউ মনোনয়ন পাচ্ছে আবার কেউবা না পেয়ে স্বতন্ত্র হচ্ছে।বিগত দিনে যারা বিদ্রোহী ও বহিস্কৃত তারাই এখন নিজ দলে থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করছে।একটা সরকার এক টানা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছে যে করনে তাদের বহুমাত্রিক দাপটে রাজপথে প্রধান বিরোধীদল সহ কোন রাজনৈতিকদল মাঠে-ময়দানে শান্তিপূর্ণভাবে কোন কর্মসূচী পালন করতে পারেনা।দলীয় কার্যালয় খুলতে পারেনা,আবার অনেক সময় দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে মানবন্ধন করতে হয়।আবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় নেতা কর্মীদের কারাগারে গুদামজাত করে ইচ্ছেমত নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়ে গেল। অথচ বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রনের কথা বললেই সরকার নানানভাবে অপারগতা প্রকাশ করেন।বিষয়টি কেমন যেন হয়ে গেল না।তাই দেশবাসী ভাল করেই জানেন যে,বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীনদের হাতেই রয়েছে।

তাই আমি মনে করি,কোন দল ক্ষমতায় আছে?কতদিন থাকবে?এর পর আবার কোন দল আসবে? এটা আমার কাছে কোন বিষয় নয়,এটা রাজনীতিবিদদের বিষয়।মূল কথা সুস্থ্য ধারার বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক সাধারন মানুষের যে প্রাপ্য,এই মৌলিক অধিকার টুকুন ফিরে পেলেই বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ বা একেবারে হতদরিদ্র মানুষের মাঝে স্বস্তির নি:শ্বাস ফিরে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক:এম.এ.জলিল রানা,জয়পুরহাট

***** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলার জনপদ-এর নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলার জনপদ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না*****

আরো দেখুন

সম্পরকিত খবর

Back to top button