Featuredঅন্যান্য

তারুণ্যে ভরা শীতের ঋতু

শীতের সকাল। ছবিটি সম্প্রতি পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর মাজদিয়া থেকে তোলাছবি: সঞ্জয় চৌধুরী

শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন নিঝুম রাত্রি। পৌষের কনকনে হিমেল হাওয়ায় জড়োসড়ো প্রকৃতির সব প্রাণী। পৃথিবীর মানুষগুলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাখিরাও নীড়ে ফিরে আসছে সন্ধ্যার আগেই ছানার কাছে। হিমায়িত রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন শহর, নগর, আর গ্রামের ব্যস্ত মানুষগুলো উষ্ণতায় সন্ধি স্থাপন করে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে শীতের চাদর মুড়িয়ে। আলোময় ব্যস্ত শহরের ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো জ্বলছে রাতভর। প্রকৃতি সেজেছে অপূর্ব সাজে। ঝরা পাতার নৃত্যে গালিচা সেজেছে সবুজের বুকজুড়ে। ঝিরিঝিরি শিশিরের ছোঁয়া পেতে ফুটে আছে পথের ধারে ঘাসফুল। মনোরম পরিবেশে শিথিলতা এনে দেয় মনে সকালের আবহাওয়ায়। গাঁয়ের মেঠো পথে হেঁটে চলে কত পথিক, হলুদ শর্ষের মৃদুমন্দ ঘ্রাণে মাতোয়ারা তাঁর মন প্রাণ।

শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় স্নান করে চুপসে আছে প্রকৃতির সবুজ পল্লব। দূর্বাঘাসে ঝিলিক ছড়াচ্ছে সোনালি মিষ্টি রৌদ্দুর। পৌষ পাবনে কাক ডাকা ভোরে শহর আর গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটছে কাজের সন্ধানে। শৈত্যপ্রবাহের আবছা আলোয় ঢেকে আছে নগরীর প্রতিটি প্রান্ত। শীত এলেই আমাদের দেশে শুরু হয় পিঠাপুলির বিশাল আয়োজন। ষোলোআনা বাঙালির মহোৎসব শুরু পিঠাপুলির ধুমধাম আয়োজনে। নতুন ধানের গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের ঘর। শুরু হয় আনন্দে মুখরোচক উৎসব। নতুন চালের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত গ্রামের সব বাড়ি। শহরের জীবনেও তার দেখা মিলে। রাস্তার ধারে বসে পিঠা তৈরির ব্যাপক ধুম পড়ে। পাওয়া যায় মুখরোচক সব ধরনের পিঠা।

গ্রামের রূপ অনেকটা পাল্টে যায় শীতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে। যেন প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ ছোঁয়া আর অপরূপ সৌন্দর্যে মনটা ভরে উঠে।

পিঠার সঙ্গে খেজুর গুড় আর খেজুরের রসের দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। চমৎকার মিষ্টান্নতায় ভরপুর সুমিষ্ট রস। বাড়িতে নানা রকম পিঠা তৈরি করেন মায়েরা, অতি আদরের সন্তান আর প্রিয় মানুষগুলোর জন্যে। উল্লেখযোগ্য কিছু মজার পিঠা হলো ভাপা পিঠা, চিতই, পাটিসাপটা, দুধপুলি, মালপোয়া, দুধ চিতই ইত্যাদি। মায়েদের কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি পিঠা তৈরি করতে। আমার মাও খুব ভালো পিঠা তৈরি করেন। সকালে উনুনের এক পাশে বসে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। মা পরম যত্নে ভালোবেসে পিঠা তৈরি করেন। মায়ের ভালোবাসা জীবনের সর্বত্র জড়িয়ে আছে; শৈশব থেকে কৈশোরে, এভাবেই থাকবে আমৃত্যু।

শীতের সবুজ শাকসবজিগুলো যেন সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বড় নেয়ামত। শর্ষে ফুলের গন্ধে মুখরিত গ্রামাঞ্চলের চারদিক। বাতাসে সুবাসিত ঘ্রাণে প্রাণ কেড়ে নেয়। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কেবল আমাদের দেশেই দেখা যায়। কনকনে শীতের মৌসুমে প্রকৃতির সতেজতায় চমৎকার লাগে চারপাশের পরিবেশ। অতিথি পাখিরা দল বেধে আসে দূরদিগন্ত থেকে। খাল, বিল, জলাশয়, হাওর, বাঁওড়ে, নদীর চারপাশটা মুখরিত করে তুলে। হিমেল হাওয়ায় দোলা জাগায় মনে। কবিত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কবি–সাহিত্যিকেরা হাতের জাদুতে সৃষ্টি করে তোলেন নতুন নতুন শৈল্পিক বুনন। তাঁদের কলমের আঁচড়ে সৃষ্টি হয় কত কবিতা, গল্প। লেখার ভাষ্যে আর অধিক শব্দতরঙ্গে গড়ে উঠে অনন্য, সুন্দর শ্রুতিমধুর বাক্যবিন্যাসের নিপুণ সব সাহিত্যের।

গ্রামের রূপ অনেকটা পাল্টে যায় শীতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে। যেন প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ ছোঁয়া আর অপরূপ সৌন্দর্যে মনটা ভরে উঠে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। শীতের সময় গ্রামে গাছিয়ালদের খেজুরের রস সংগ্রহ করা, কাঁধে করে রসের হাঁড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরা, বাড়ি বাড়ি টাটকা শাকসবজি নিয়ে সবজিওয়ালাদের আসা, খেতখামারে কৃষকদের নিজের হাতে কাজ করা—এসব দৃশ্য কেবল গ্রামে থাকা মানুষগুলোই উপভোগ করতে পারেন। শহরে এই দৃশ্য দেখা যায় না। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের আলো–বাতাস, মা, মাটি ও প্রকৃতির সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছি। নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো, পুকুরে গোসল করা, প্রকৃতির মধ্যে ঘুরাফেরা, স্নিগ্ধ সতেজ আর নির্মল বাতাসে খুঁজে পেয়েছি অপরূপ সৌন্দর্য্যের ছোঁয়া। শীতের পরেই আসে বসন্ত ঋতু। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এখানে প্রতিটি ঋতুতে অপূর্ব সুন্দর করে সেজে উঠে প্রকৃতি। বসন্ত ঋতুতে ফুটে ওঠে নানা রকম ফুল।

শীতের শেষে পাতা ঝরার অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্য দেখা যায়। ঝরাপাতার গালিচায় হেঁটে যাওয়া ভীষণ ভালো লাগে। শীতের আমেজে আর ফুরফুরে বাতাসে নেচে ওঠে ঘাসফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল। বাংলাদেশের মতো এমন চমৎকার দৃশ্য আর কোথাও দেখা যায় না। চিরকাল হারাতে চাই এই প্রকৃতির বুকে ভালোবেসে। আবিষ্কার করতে চাই বাংলার রূপ-বৈচিত্র্য। মা, মাটি আর মানুষের প্রেমে ডুবে থাকতে চাই আমৃত্যু। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে এক টুকরো সবুজ বাগিচা। এখানে ফুলে ফুলে দোল খেলে ভ্রমর। নদীর বুকে উড়ে বেড়ায় সাদা বক আর নাম না জানা কতরকম পাখি। ঋতুচক্রে ঘুরে আসে বৈচিত্র্যময় আয়োজন। ষড়ঋতুর এই খেলায় বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়েছি বারংবার। মুগ্ধতা ছেয়ে যায় আমার কবিত্বময় মনে। এমন দেশের মাটিতে জন্মেছি বলে ভীষণ আনন্দ হয়। ভালোবাসি এই বাংলা মায়ের চিরসবুজ রূপ।

মমতা মজুমদার

আরো দেখুন

সম্পরকিত খবর

Back to top button