উপ-সম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধ জয়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর আদর্শ

সাদিকুর রহমান :  বিশ শতকের প্রারম্ভে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বিকশিত শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত নানান ঐতিহাসিক কারণে পাকিস্তান আন্দোলনে সাময়িকভাবে বিচ্যুত হলেও এখান থেকেই তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে।

মুসলিম লীগের এলিট রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলার মুসলমানদের তৎকালীন প্রান্তিক অবস্থার সুবিধাটিকে ধর্মীয়আবরণ দিয়ে সুকৌশলে ব্যবহার করে পাকিস্তান আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ করেছিল। অথচ ১৯৪৭ পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অভিমুখীন বাঙালী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনগোষ্ঠীর।

বাংলার এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে গ্রামীণ কৃষক সমাজ থেকে উঠে আসা নবীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যারা খুব দ্র“তই ধর্মীয়আবরণে এলিটদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক অবস্থাকে বুঝতে পারে।

বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানও (১৯২০-১৯৭৫) গ্রামীণ কৃষক সমাজের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিলেন । তাঁর সাথে যে ‘নেতৃত্বের সম্মিলন’ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ও লক্ষ্যে সাধিত হয় তার অপর প্রধান চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)। তাজউদ্দীন আহমদও শেখ মুজিবুর রহমানের মতো গ্রামীণ কৃষক সমাজ থেকে উঠে আসা শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশে গ্রামীণ কৃষক সমাজ থেকে বিকশিত এই নবীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক তর“ণ নেতৃত্ব খুব দ্রুতই মুসলিম অভিজাত নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক অবস্থানকে বুঝতে পারে।

সেই সাথে তারা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য পথানুসন্ধান করতে থাকে। ১৯৪৭ সাল পরবর্তী অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশের স্বাধিকার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা পাওয়া যায় তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৪৭-৪৮ সালের ডায়েরিতে, যা তাঁর ডায়েরির প্রথম খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত। ডায়েরির, এই খণ্ডে ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ তারিখের লেখায় এর স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

বলা যেতে পারে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রথম দালিলিক চিন্তাভাবনা তাজউদ্দীনের ১৯৪৭-৪৮ সালের ডায়েরিতে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ প্রণীত এবং ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণ’-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পরই চিন্তাভাবনা ও কর্মতৎপরতার যে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় তার ধারাবাহিকতায় এই দুই নেতা পরস্পরের সম্পূরকই শুধু হয়ে ওঠেননি, বরং সাংগঠনিকভাবেও তারা মূল অবস্থানে চলে আসেন। অন্তত ইতিহাস তাই-ই প্রমাণ করে।

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুর“ হয় তাঁর বাবা মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াসিন খানের কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু‘ বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদ প্রেক্ষাপটের প্রতিকুলতাকে অত্যন্ত সচেতনভাবে অতিক্রম করে এবং একই সাথে ইতিহাসকেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন।

ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা তাজউদ্দীনই শিক্ষা জীবনে পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের পরিবার থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৪৮ সালে উ”চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। পাশাপাশি তিনি পবিত্র কোরআন-এ হাফেজ ছিলেন। তাজউদ্দীন স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতি তথা প্রগতিশীল আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

রাজনীতি ও শিক্ষা তাঁর হাতে হাত ধরে চলেছে। জীবন মৃত্যুতে মহীয়ান, স্বাধীনতা ও ত্যাগের গৌরবস্পৃষ্ট, মানবিক উদার ও স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী, শোষণহীন সমাজের স্বপ্নদ্বারা প্রাণিত এই মানুষটির হয়ে ওঠার একটা বিস্তৃত ইতিহাস আছে। আর এ বিস্তৃত ইতিহাসের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর সকর্মক তাজউদ্দীন কর্ম ও তত্ত্বে বিশ্বমানের বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাই তার জ্ঞান ও যুক্তিকে অক্সফোর্ড পড়ুয়া ভুট্টো পর্যন্ত ভয় পেতেন।

বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। এ বিষয়টিতে পর্যালোচনা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। তবে তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শবাদীতার প্রতি আলোকপাত করতে হলে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা উচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম পরিচয় ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময় কলকাতায়।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্যটি পাওয়া যায়। এ প্রতিবেদনে আরো যা প্রকাশ হয় তা হলো: প্রথম সাক্ষাতের সময় থেকে তাদের দুই জনের মধ্যে একটা ভাবের আদান-প্রদান হয়েছিল। তদবধি তাদের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক চলে আসছে। একই প্রতিবেদনে অন্য একটি জায়গায় লেখা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ সাতাশ বছরের একনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দীন ‘।

আলী তারেকের মতে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম ছিলেন, আর সেই নামের নেপথ্যে যে ব্যক্তি কাজ করতেন তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। শেখ মুজিবের মাঝে তাজউদ্দীন একাত্ম হয়েছিলেন।’ কফিল উদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, ‘আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কাছ থেকেই নয়, শেখ সাহেবের কাছ থেকেও শুনেছি যে তারা দুজন অবিচ্ছেদ্য ছিলেন এবং তারা এক সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিংবা তারা দু’জনে শহর থেকে বহুদূরে লোকালয়ের বাইরে দিয়ে গভীর রাত্রে তাঁদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করেছেন।’ এরকম প্রচুর ঐতিহাসিক উপাদান প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন-এর মধ্যকার সম্পর্ক অবি”েছদ্য ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় দেওয়ার পরও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবিচ্চেদ্য ছিল অন্তত আনুগত্য পর্যায়ে। বঙ্গবন্ধুর মানসিক কষ্ট যা আরহাম সিদ্দিকীর সূত্র থেকে জানা যায় তাতেও প্রমাণ করে তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু কি পরিমাণ

ভালবাসতেন। এটা সত্য যে, ষড়যন্ত্রকারীরা এই দুই নেতার মধ্যে রাজনৈতিক বিচ্ছেদ যাকে বাংলার ইতিহাসের ‘ট্রাজেডী’ বলা হয় তাতে সফল হয়েছিল। তবে এই ঐতিহাসিক ‘ট্রাজেডির’ পরও মানবমুখী চিন্তায় বিশ্বাসী তাজউদ্দীন তার চিন্তায়, মননে, নেতার প্রতি আনুগত্যে ও আদর্শে অবিচল ছিলেন।

তাজউদ্দীন আহমদ আত্মপ্রচারবিমুখ গণমনস্ক রাজনৈতিক কর্মী ও চিন্তক ছিলেন। তার সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে বিষয়টি ধরা পড়ে তা অত্যন্ত বিরল। তিনি নেতৃত্বের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জাতীয় মুক্তির স্বরূপ এবং সামষ্টিক চেতনাকে নেতৃত্বের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় প্রবিষ্ট করে লক্ষ্যার্জনে এগিয়েছেন।

এজন্য দেখা যায় যে, তিনি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি প্রধান নেতার ইমেজ কত উত্তম এবং নির্ভুলভাবে উপ¯’াপন করা যায় তার প্রতিও সদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে যে বিবৃত্তি বা বাণী কিংবা বক্তব্য লিখতেন তা তার নিজের জন্য লেখা বক্তব্যের চাইতে আরো উত্তম করে লিখতেন। শুধু তাই নয় তিনি প্রধান নেতার সিদ্ধান্তে বা কোন কিছুতে যাতে কোনরূপ বিরূপতা জনমানসে দেখা না দেয় সে দিকেও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতেন।

কারণ তাজউদ্দীন তীক্ষন বিশ্লেষণ ও অসাধারণ সৃজনক্ষমতায় স্পষ্টই বুঝেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুসংগঠিত আওয়ামী লীগই বাঙ্গালীর স্বাধীকার দিতে পারবে। কেননা তিনি যেন তেন রাজনীতিক. সমাজ চিন্তক ছিলেন না বরং বিশ্বমানের একজন রাজনীতিক, সংগঠক ও চিন্তক ছিলেন। তাই ক্ষণিকের হাততালি বা বাহবার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। জন্মভূমিকে ভালবেসে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বাংলার দুখী মানুষের মঙ্গলের জন্যই কাজ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদের প্রিয় নেতা বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের ¯ প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য কিংবদন্তীর মত। তিনি বঙ্গবন্ধুর নামেই ন’ মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন এবং সমস্ত বিজয় নেতার হাতে তুলে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে দৃষ্টান্ত ¯’স্থাপন করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জটিল কালপর্বে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপউন্থিতিতে অসীম ধৈর্য্য, অকৃত্রিম নিষ্ঠা, অনন্য সাধারণ সৃজনক্ষমতা, অতুলনীয় মেধা, সততা ও বিরল আনুগত্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং দেশকে হানাদার মুক্ত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের অন্য জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামর“জ্জামান তারাও প্রত্যেকেই অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কঠিন অবস্থায় কাজ/দায়িত্ব পালন এবং খুব স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন।

কিন্তু‘ ৭১’এ ইতিহাস তাজউদ্দীনের উপর বেশি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তাজউদ্দীন নির্মম আনুগত্যে ও নির্মোহভাবে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। অভ্যন্তরীণ ও আšতর্জাতিক কত সমস্যা ও জটিলতার মোকাবেলা করে তাকে যে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তা বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য শিক্ষণীয়।

তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তি চিন্তার বিপরীতে সমষ্ঠির কল্যাণ, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সামগ্রিক মুক্তিতে বিশ্বাস করতেন এবং এইভাবেই তার রাজনৈতিক কার্যক্রমকে পরিচালিত করেছিলেন। তার সমাজ ভাবনা, রাষ্ট্র ভাবনা, উন্নয়ন চিন্তা সবকিছুই গণমানুষ কেন্দ্রিক। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরী, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও স্বাধীনতা পরবর্তী বক্তব্য বিবৃতি থেকে তাজউদ্দীন আহমদের সমাজ, রাষ্ট্র ও উন্নয়ন চিন্তার যে চিত্তাকর্ষক দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায় তা একটি সবল জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য।

তার স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিষয়ক বিস্তৃত চিন্তা, সমাজ উন্নয়নে গণমানুষের অংশীদারীত্বের চিন্তা, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা, মৌলিক মানবিক প্রয়োজন ও অধিকারের নিশ্চয়তা বিষয়ক চিন্তা, পরিকল্পিত জনকল্যাণমুখী শিক্ষা ব্যবহার চিন্তা, বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ক চিন্তা, জাতি পুনর্গঠনে মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ সমাজকে নিয়োজিত করার চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা, সদ্য স্বাধীন দেশের আত্মনির্ভরশীলতার জন্য পার্টি সম্পর্কিত চিন্তা, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্পর্কিত ভাবনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, খাদ্রসমস্যা মোকাবেলা ও পরিবেশ বিষয়ক চিন্তাগুলোতে অত্যন্ত গভীর একজন চিন্তকের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ে যে চিন্তাগুলো নবীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভেবেছিলেন সেগুলো যে কত গভীর ঐতিহাসিকতায় প্রোথিত তা এখন দিবালোকের মতো সত্য।

ব¯‘ত তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর সুশৃঙ্খল জীবন, শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মেধা, যোগ্যতায় ও চিন্তাভাবনায় মনীষী তুল্য। ইতিহাসের এক জটিল কালপর্বে দাড়িয়ে অসীম ধৈর্য, অকৃত্রিম নিষ্ঠা, অনন্যসাধারণ সৃজনক্ষমতা, অতুলনীয় মেধা, সততা ও বিরল আনুগত্যে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রকে বাস্তবে উন্নীত করেছেন এবং সমস্ত বিজয় ¯’পতির হাতে তুলে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে দৃষ্টান্ত ¯স্থাপন করেন।

তাজউদ্দিন আহমদ এক অতুলনীয় কর্ম ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ বিশ্বমানের বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি নেতৃত্বের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখেছেন সামষ্টিক চেতনার স্বরূপ এবং সামষ্টিক চেতনাকে নেতৃত্বের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় প্রবিষ্ট করে লক্ষ্যার্জনে এগিয়েছেন। ব্যক্তি চিন্তার বিপরীতে সমষ্টির কল্যাণ, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সামগ্রিক মুক্তিতে বিশ্বাসী এই মনীষী। ঐতিহাসিক ‘সম্মিলনে’ ঐতিহাসিক ’ট্রাজেডির’ পরও মানবমুখী চিন্তায় বিশ্বাসী এই মানুষটি তার চিন্তায়, মননে ও আদর্শে অবিচল। তার সমাজ ভাবনা, রাষ্ট্র ভাবনা, উন্নয়ন চিন্তা সবই গণমানুষ কেন্দ্রিক। তাই তাজউদ্দিন হয়ে ওঠেন সভ্যমানুষের অনুসরণীয় নৈতিক মানের আদর্শ ব্যক্তিত্ব, অধ্যয়ন ও চর্চার ক্ষেত্র।

সততা ও আদর্শের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ জয়ী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি ও চিন্তাভাবনাসমূহের মধ্যে মানুষ আর স্বদেশের কল্যাণ খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে সম্পদ সৃষ্টি অন্যদিকে তার সুষ্ঠ বিতরণ এবং পরিকল্পিত ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নই ছিল তাঁর আরাধ্য। তিনি তাঁর চিন্তা ভাবনায় ছিলেন খুবই বাস্তববাদী, প্রয়োজনে কৌশল বদলে ফেলার মানসিকতাও তাঁর ছিল। কিš‘ নীতি ও আদর্শে ছিলেন অটল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সমাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সমন্বয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন।

জনগণকে নিরন্তর তথ্য দেবার পক্ষে ছিলেন তিনি। প্রকৃত অবস্থা জাতিকে জানানো এবং মানুষের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণের একটা প্রবণতা তাঁর ছিল। জনসাধারণের দারিদ্র্য নিরসন, সুষম বণ্টন, বেশি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের লক্ষ্য নিয়ে তিনি চিন্তা ভাবনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। মানবমুখী চিন্তায় বিশ্বাসী এই মানুষটি তার চিন্তায় মননে ও আদর্শে অবিচল। বর্তমান দুর্বৃত্তায়ন বি¯তৃতির সমাজে সময়ের দূরত্ব ও ঐতিহাসিক পার্থক্য সত্ত্বেও তাজউদ্দিনের আদর্শবাদ ও চিন্তার সাথে আমাদের বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রচারবিমুখ এই বাঙালি রাষ্ট্রনেতার চিন্তা ও কর্মকে মূল্যায়নের বা অধ্যয়নের যে প্রেক্ষাপট তা নিতান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক নয় বরং বর্তমান জটিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আত্মমর্যাদাশীল ও জনকল্যাণমুখী দেশ বিনির্মাণের লড়াই সংগ্রামে তাকে বড় প্রয়োজন।

লেখক : সাদিকুর রহমান (পিএইচডি), গবেষণা প্রধান , গবেষণা বিভাগ, বিএলটি,ঢাকা, বাংলাদেশ; গবেষণা সহযোগী সমাজবিজ্ঞানী রিয়েন গবেষণা গ্রুপ, ইউরোপ।

আরো দেখুন

সম্পরকিত খবর

Back to top button